পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০১০

ধুমপান: একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ





অনেক দিন যাবত ভাবছিলাম ধুমপান বিষয়ে কিছু লিখব। তাই ধুমপান লিখে গুগলে সার্চ দিয়ে মাহফুজশান্ত নামের এক ডাক্তারে বাংলা ব্লগ খুজে পেলাম। লেখাটি খুব ভাল লাগল। তাই কপি পেষ্ট করলাম। ধন্যবাদ ডাক্তার ভাই।

'ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর'- শুধু ক্ষতিকর বললে কম বলা হবে। বরং বলা উচিত- 'ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর'। তা প্রত্যক্ষ হোক, কিংবা হোক পরোক্ষ ধুমপান। ধুমপানের কারণে এ পৃথিবীতে অনেক মানুষ সবার অজান্তে অকালেই ঝরে যাচ্ছে। ধুমপানের ফলে সৃষ্ট তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। তামাকে যে নিকোটিন থাকে তা ভয়ানক আসক্তির সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায় যে নিকোটিন থাকে তা হিরোইন অপেক্ষা শক্তিশালী।

*ধুমপানের সময় শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া নিকোটিন আতিদ্রুত (সাত সেকেন্ডের মধ্যেই) মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। যার প্রভাবে মস্তিষ্কের সূহ্ম রক্তনালী সংকোচনের ফলে অক্সিজেন সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেইসাথে বিষাক্ত কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাস রক্তে অনুপ্রবেশের ফলে মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বুকে ব্যথা সহ হৃদপিন্ডের রক্তনালীর রোগ (clogged arteries) ও ফুসফুসের ক্ষতি হয়। সিগরেটের মধ্যে নিহিত রাসায়নিক উপাদান ও বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ব্রঙ্কিয়াল এজমা, এম্ফাইসেমা, ব্রোঙ্কাইটিস, হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ, হার্ট-এটাক, স্ট্রোক এবং ক্যান্সার হয়।

*ধুমপানের ফলে ডিস্‌লিপিডে- মিয়া হতে পারে অর্থাৎ রক্তে চর্বির মাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে ও ক্ষতিকারক লিপিডের পরিমাণ বৃদ্ধিতে নিকোটিনের ভূমিকা থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে অধুমপায়ীদের তুলনায় ধুমপায়ীরা দুই থেকে তিন গুণ বেশী স্ট্রোক ও হার্ট-এটাকে ভোগে। গবেষণার আলোকে জানা গেছে যে, এল.ডি.এল-কোলেস্টেরল (low-density lipoprotein cholesterol -LDLc ) এথেরোস্ক্লেরোটিক প্লাকের সূত্রপাত ঘটায়, আর ধুমপান উক্ত প্লাকের অগ্রসরণের সাথে সংশ্লিষ্ট। ক্যারোটিড ধমনীতে ইকোলুসেন্ট-প্লাক তৈরিতে এল.ডি.এল-সি এর সংশ্লিষ্টতা বেশী এবং ধুমপানের সংশ্লিষ্টতা ইকোজেনিক-প্লাক তৈরিতে। প্লাকের সূত্রপাত ঘটাতে ও তা ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে এল.ডি.এল-সি মুখ্য ভুমিকা পালন করে। অন্যদিকে ধুমপানের কারণে এই প্লাক আরও শক্ত ও আঁশযুক্ত হয়।

*ধুমপায়ী মাতাদের ক্ষেত্রে মৃত-সন্তান প্রসব, অপূর্ণকালিক ও কম ওজন বিশিষ্ট সন্তান প্রশব বা গর্ভপাতের হার অনেক বেশী হয়।

*ধুমপান জনিত ক্যান্সারে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদের মধ্যে ২২% -ই ফুসফুসের ক্যান্সার রোগী এবং যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের চারজনের মধ্যে একজন লোক ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে থাকে। একনাগারে ৪০ বছর ধুমপান করলে স্তন-ক্যান্সারের সম্ভাবনা ৬০% বেড়ে যায় এবং এই ধুমপানের পরিমাণ প্রতিদিন এক প্যাকেট বা তার বেশী হলে এই ঝুঁকি ৮৩% বৃদ্ধি পায়। মুখ ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৯০% লোকই তামাক গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও লিভার, প্যাংক্রিয়াস, পাকস্থলি, মূত্রথলি, কিডনী ও সারভাইকাল ক্যান্সারও হতে পারে।



*সমপ্রতি গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, ধুমপানের কারণে ডিএনএ অনুক্রমের পরিবর্তন ঘটতে পারে। এর ফলে একজন পিতা যিনি ধুমপান করেন তার সন্তানেরা (inherit genetic damage) 'জিন' বা বংশগতি সম্বন্ধীয় ক্ষতির উত্তরাধিকারী হতে পারে। বিজ্ঞানী ও গবেষক ('Carole Yauk, Ph.D' - lead author of the study and research scientist in the Mutagenesis Section of Health Canada's Environmental and Occupational Toxicology Division.) এর মতে একজন ধুমপায়ী মাতার কারণে ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু একজন ধুমপায়ী পিতা তার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের অনেক আগেই সম্ভাব্যরূপে আগত সন্তান-সন্ততির ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই যারা ভাবেন সন্তান জন্মাবার পরে ধুমপান ছেড়ে দেবেন, তারা ঠিক ভাবেন না। বরং সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় থেকে এবং প্রচেষ্টা চালানোর বেশ আগে থেকেই ধুমপান বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। মূল প্রবাহের তামাকের ধোঁয়ায় (Mainstream tobacco smoke - MTS) প্রায় ৪০০০ রাসায়নিক উপাদান থাকে, যেগুলোর বেশীর ভাগই (genotoxic) বংশানুগতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক উপাদান 'জীন্‌' -এর জন্য বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। সুতরাং বলা যায় যে, যারা সরাসরি তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে এসেছে তাদের কারণে তাদেরই ভবিষ্যৎ বংশধরেরা (যারা কখনই তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসেনি) বংশগতি সম্বন্ধীয় রোগের বাহক হিসেবে জন্ম নিতে পারে। সুতরাং এখনই সাবধান না হলে (genetic disease) বংশগতি সম্বন্ধীয় রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যে দিন দিন বৃদ্ধি পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

*ধুমপানের কারণে স্বাদ ও গন্ধ নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। সমপ্রতি এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যুবক বয়সেই ধুমপায়ীদেরকে বৃদ্ধের মত দেখায় এবং যে যত দীর্ঘ সময় ধরে যত বেশী বেশী ধুমপান করে তার মুখের চামড়া তত তাড়াতাড়ি ও তত বেশী কুঁচকে যায়। ধুমপান করলে আঙ্গুল, দাঁত ও ঠোঁট বিবর্ণ হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস, চুল ও কাপড়ে দূর্গন্ধ হয়।

*নিজে নয় দ্বিতীয় অর্থাৎ অন্য কোন ব্যক্তির কারণে ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া বা ফুসফুসে টেনে নেয়াকে পরোক্ষ ধুমপান (Passive smoking) বলা হয় এবং যা সাধারনত দুর্ঘটনাজনিত বা অনবহিতভাবে ঘটে থাকে। তামাক অর্থাৎ সিগারেট, বিরি বা চুরুটের ধোঁয়া এতই মারাত্মক যে এতে প্রায় তিনশ'র মত এমন সব রাসায়নিক উপাদান থাকে যেগুলো Carcinogenic অর্থাৎ ক্যান্সার উৎপন্ন করে। পরোক্ষ ধুমপান প্রত্যক্ষ ধুমপানের মতই মারাত্মক ও প্রাণঘাতি। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে শুরু করে আরও অনেক গুরুতর স্বাস্থ্যহানী ঘটতে পারে। ক্যালিফোনিয়া এনভায়র্নমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি -(California Environmental Protection Agency) এর মতে অক্রিয় ধুমপানের কারণে মহিলাদের স্তন-ক্যান্সার ও অপূর্ণকালিক সন্তান প্রশবের হার বেড়ে যায়। তাছাড়া এর ফলে হাঁপানি, ফুসফুসে ইনফেক্সন ও রক্তসঞ্চালনে সমস্যা হতে পারে। পরিবারে পিতা-মাতা ও অন্যান্য সদস্যদের ধুমপানের কারণে নিষ্পাপ কোলের-বাচ্চা ও ছোট ছোট শিশুরা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ধুমপায়ীদের শিশু-সন্তানেরা খুব সহজেই কাশি, সর্দি, ফুসফুসের সমস্যা তথা ব্রঙ্কিয়াল এজমা, কানের ইনফেক্সন, হৃদরোগ, এমনকি পরবর্তী জীবনে ফুসফুসের ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারে এবং মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হলো; 'Colorado State University' ও 'University of Massachusetts'-এর পর্যবেক্ষণ অনুসারে ধুমপায়ী গৃহস্বামী ও অন্যান্য সদস্যদের ধুমপানের কারণে নিরীহ গৃহপালিত পশুরাও রেহাই পাচ্ছে না এবং এর ফলে গৃহপালিত কুকুর- 'Canine lung cancer' ও বিড়াল- 'Feline lymphoma' নামক অজ্ঞাত ক্যন্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

*তামাকের ধোঁয়া তেল-চালিত যানবাহন অপেক্ষা অনেক বেশী পরিমাণে পরিবেশকে দূষিত করে। সমপ্রতি ন্যা্লাল ক্যান্সার ইন্‌স্টিটিউট - ('particular matter' - PM emission test) 'পদার্থ কণিকা নির্গতকরণ পরীক্ষা'-এর মাধ্যমে গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে, ডিজেল চালিত মন্দগতিতে চলা যন্ত্রের চেয়েও তামাকের ধোঁয়া অধিক হারে দূষণ সৃষ্টি করে।

*আর্থিক ক্ষতির কথা বিচার বিশ্লেষণ করলে একজন ধুমপায়ীকে “সচল টাকা পোড়ানর যন্ত্র”-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সে নিজে যেমন তার আয়ের একটা বড় অংশ বিষপানে ব্যয় করে, তেমনি অন্যদেরকে অনিচ্ছা সত্বেও বিষপানে বাধ্য করে। একজন ধুমপায়ীকে অমিতব্যয়ী বললে অত্যুক্তি হবে না এবং এতে তার রাগ করারও কিছু নেই। হিসেবের খাতা খুললে সে নিজেই তার বাস্তব প্রমাণ পেয়ে যাবে।

*মানুষ মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে সকল সৃষ্টিকুলের হিত সাধনের দায় মানুষের উপরেই বর্তায়। একজন ধুমপায়ী কখনই একজন খাঁটি মানবতাবাদী নয়। বিশেষ করে রাস্তা-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, ইউনিভার্সিটিতে যারা সিগারেট জ্বালিয়ে আঙ্গুলের ডগায় নাচিয়ে নাচিয়ে মানবতার কথা বলে, তারা নিজের সাথে নিজেরাই প্রতারনা করে। যারা ধুমপায়ী তাদের কাছে আমার প্রশ্ন যে তারা ধুমপানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষতি করছেন ভাল কথা (যদিও তাদের এটা করা উচিৎ নয়) কিন্তু অন্য মানুষের ক্ষতি করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? অক্রিয় ধুমপায়ীরা যদিও এ অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত নয়। তবে যারা ধুমপায়ীদেরকে ধুমপান থেকে বিরত রাখার জন্য চেষ্টা করেনা বা অন্ততপক্ষে এর বিরুদ্ধে কিছুই বলেনা, তারাও কিন্তু এ অপরাধের দায় থেকে পুরপুরি মুক্ত নয়। সুতরাং আসুন একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে ধুমপানের মত মানবতা বিরোধী, মারাত্মক ও মন্দ নেশাকে চিরতরে বর্জন করে সুস্থ ও কর্মময় জীবনের জন্য শপথ নেই। তরতাজা হৃদপিন্ড ও ফসফুসের অধিকারী হয়ে নিজেরা বুক ভোরে বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নেই এবং অপরকেও সে সুযোগ করে দেই। আমাদের চারপাশে যারা আছে সবার কথা ভেবে, বিশেষ করে নিষ্পাপ শিশুগুলোর মায়াভরা মুখের দিকে তাঁকিয়ে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তামাক-মুক্ত ও দূষণমুক্ত পরিবেশ গঠনে উদ্যোগী হই। সবশেষে আরও একটা প্রশ্ন আমি করতে চাই সেটা হল, সন্ত্রাসী যদি কাউকে মেরে ফেলে তাহলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে যদি শাস্তি দেওয়া যেতে পারে তাহলে ধুমপায়ীর কারনে অন্য মানুষের যে ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য তাকে কেন শাস্তি দেওয়া যাবে না?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন